ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক বর্ধমান হাউস






গাজী মুনছুর আজিজ

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীর মূল ভবন বর্ধমান হাউসসাদা ধবধবে ভিক্টোরিয়া আমলের বাড়ি এটিএকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে ভাষার মাসে বসে একুশে বইমেলাশুধু বইমেলা বললে ভুল হবে, এটি প্রাণের মেলাওযে বাড়িটিকে কেন্দ্র করে এতসব আয়োজন সেই বর্ধমান হাউসের ইতিহাসটুকু একেবারেই তুচ্ছ নয়
নির্মাণ কাহিনী
বর্ধমান হাউসের ক্ষেত্রে যে কথাটি বেশি প্রচলিত আছে সেটি হচ্ছে বর্ধমানের মহারাজা এটি নির্মাণ করেন১৯০৬ সালে ঢাকা যখন প্রাদেশিক রাজধানীতে পরিবর্তিত হয় তখন সাবেক হাইকোর্ট ভবন, কার্জন হল প্রভৃতির সঙ্গে বাংলা একাডেমীর বর্ধমান ভবনটিও নির্মিত হয়সম্ভবত এই ভবনটি তকালীন সরকারি উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ও অতিথিদের জন্য বাংলো হিসেবে ব্যবহার করা হতোবর্ধমানের মহারাজা যেহেতু ১৯১৯-২৪ সাল পর্যন্ত গভর্নরের শাসন-পরিষদের সদস্য ছিলেন তাই তিনি ওই সময় পর্যন্ত এই ভবনটিতে রাজকীয় অতিথি হিসেবে বাস করতেনফলে একসময় তার নামানুসারে এ বাড়িটির নাম হয়ে যায় বর্ধমান ভবনঅনেকের ধারণা, বর্ধমানের মহারাজাই বর্ধমান ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন
ভবন বৃত্তান্ত
বাড়িটির গঠন প্রকৃতিতে এটিকে ভিক্টোরিয়ান রীতিতে ফেলা শ্রেয়তরএর অর্ধচন্দ্রাকৃতির বারান্দা, নিচতলার নাচের বলরুমের পাশাপাশি দ্বিতীয় তলায় ফায়ার প্লেস এ সবকিছুই তারই সাক্ষ্য বহন করেপ্রথম দিকে বর্ধমান ভবন দোতলা হিসেবেই নির্মাণ করা হয়েছিল১৯৬২ সালে এটিকে তিনতলায় উন্নীত করা হয়তৃতীয় তলার নকশাও ভবনের আদি নকশার সঙ্গে মিল রাখা হয়েছেসরকারি উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ও অতিথিদের বাংলো এবং বর্ধমানের মহারাজার আবাস ছাড়াও ১৯২১ সালের কিছুটা সময় এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসস্থল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়১৯২৬ সালের দিকে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন বর্ধমান ভবনের একটি অংশে বাস করতেন এবং তার কার্যালয় ছিল বর্ধমান ভবনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলার ল্যান্ডিংয়ের বাম দিকের ঘরটিএখানে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর হিসেবে কাজ করতেন তিনিকবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন এই ঘরটিতে তিনিও কিছুদিন ছিলেনদেশ বিভাগের পর এটি পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়এই ভবনের সিঁড়ি এবং দরজা-জানালাগুলো কাঠের তৈরিদীর্ঘদিন হওয়াতে সেই সিঁড়ি ও দরজা-জানালাগুলো এখন অনেকটাই ব্যবহারের অযোগ্যতাই বর্তমানে বর্ধমান ভবনের সিঁড়ি, দরজা-জানালা নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে এবং নকশা রাখা হচ্ছে আগের মতোই
বর্ধমান হাউস, ঐতিহ্য

১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর এই ভবনে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়বর্ধমান ভবনের বটতলায় এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়কালীন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দেনকালীন শিক্ষামন্ত্রী আশরাফ উদ্দীন আহমদ চৌধুরীও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন
বাংলা একাডেমীর কাজ শুরু হয় গবেষণা বিভাগ, অনুবাদ বিভাগ, সংকলন ও প্রকাশনা বিভাগ এবং সংস্কৃতি বিভাগ নামে চারটি বিভাগ নিয়েপরবর্তী সময়ে আরো কয়েকটি বিষয় যোগ করে সাতটি বিভাগ করা হয়বিভাগগুলো প্রাতিষ্ঠানিক, গবেষণা ও সংকলন, অনুবাদ, সংস্কৃতি, প্রকাশনা-বিক্রয়-প্রেস, পাঠ্যপুস্তক এবং ফোকলোর বিভাগ১৯৮৩ সালে আবার এগুলোকে চারটি বিভাগে আনা হয়
প্রাণের মেলা শুরুর কথা
দেশ বিভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যেমন তৈরি হয়েছিল এই বর্ধমান ভবনকে কেন্দ্র করে, ঠিক তেমনি এই বর্ধমান ভবনকে ঘিরেই বর্তমান একুশের বইমেলা বা আমাদের প্রাণের মেলার শুরুটা হয়েছিলআর এই মেলার শুরুটা করেন মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্বfধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহাতিনি ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান ভবন প্রাঙ্গণের বটতলায় এক টুকরো চটের উপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার যাত্রা করেনসেই বইগুলো ছিল তার প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন সাহা একাই বইমেলা করতেন১৯৭৬ সালে আরো অনেকে এর প্রতি আগ্রহী হোন১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমীর তকালীন মহাপরিচালক কবি আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমীকে এই মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতিএই সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা১৯৮৪ সালে মেলার নামকরণ করা হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলাসেই থেকেই শুরু আজকের প্রাণের মেলা
ভাষা আন্দোলন জাদুঘর
২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান ভবনের দোতলায় ভাষা আন্দোলন জাদুঘর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাচারটি কক্ষ নিয়ে সাজানো এই জাদুঘরে ভাষা আন্দোলনের নানা নিদর্শন রাখা রয়েছেজাদুঘরের নিদর্শনগুলোর মধ্যে আছে- ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট, ঘটনাবলি-সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখকের বইয়ের প্রচ্ছদ, বিভিন্ন রচনার অংশবিশেষ, ছবি ও তকালীন বিভিন্ন পত্রিকার সংখ্যাএর মধ্যে প্রথম কক্ষে ১৫টি বইয়ের প্রচ্ছদ এবং ৪১টি ছবি আছে ক্যাপশনসহদুই নম্বর কক্ষে ক্যাপশন ছাড়া একটি ছবি রয়েছেএই জাদুঘরের অধিকাংশ আলোকচিত্র অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সংগ্রহ থেকে নেওয়াগুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের প্রচ্ছদের মধ্যে আহমদ রফিকের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ও কিছু জিজ্ঞাসা’, বশীর আল-হেলালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’, বদরুদ্দীন উমরের ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ : কতিপয় দলিল’, আহমদ রফিক ও বিশ্বজি ঘোষের ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর’, রফিকুল ইসলাম ও সিএম তারেক রেজার বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন’, রতনলাল চক্রবর্তীর ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র’, মাযহারুল ইসলামের ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিবুর রহমানঅন্যতমআরো আছে মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিম রচিত নূরনামার পঙ্ক্তিমালা, বাংলা ভাষার উপর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও অতুল প্রসাদ সেনের কবিতা, ১৯৫৬ সালে শিল্পী হামিদুর রহমান প্রণীত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদি নকশা, বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দৃশ্য, মাতৃভাষার সপক্ষে প্রথম প্রস্তাবক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, রবীন্দ্রনাথের আলোকচিত্র, কালীন কিছু পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে সংগ্রামী শিক্ষার্থীদের ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি, শিক্ষার্থীদের মিছিল, ইডেন কলেজের মেয়েদের প্রথম তৈরি শহীদ মিনার, কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছিসহ অসংখ্য আলোকচিত্রএকটি কক্ষে রয়েছে শহীদ শফিউর রহমানের ব্যবহৃত কিছু জিনিস, শহীদ আবুল বরকতের বিভিন্ন পরীক্ষায় পাসের সনদ, একুশে পদক প্রাপ্তির সনদ, শহীদদের জীবনী নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থজাদুঘরটি সবার জন্য উন্মুক্তকোনো প্রবেশ মূল্য নেইবাংলা একাডেমী চলাকালীন সময়ে এই জাদুঘর দেখা যাবে
জাতীয় সাহিত্য ও লেখক জাদুঘর
বর্ধমান ভবনের নিচতলার চারটি কক্ষ নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে জাতীয় সাহিত্য ও লেখক জাদুঘর২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেনজাদুঘরের প্রথম কক্ষে রয়েছে বাংলা ভাষা, লিপি ও সাহিত্যের আদি উ, বিকাশ ও বিবর্তন, বাংলা ভাষার ছয় হাজার বছরের ক্রমবিকাশের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে চিত্রমালার মাধ্যমে, কয়েকটি ভাষাচিত্র ও তাম্র্রলিপি, কাচঘেরা আলমিরাতে সংরক্ষণ করা আছে কবি শামসুর রাহমানের ব্যবহৃত পাখির পালকের কলম, চশমা, ঘড়ি ও সম্পাদক হিসেবে পরিচয়পত্র, কবি সুফিয়া কামালের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের হাতের লেখা পা-ুলিপির অংশবিশেষ প্রভৃতিদ্বিতীয় কক্ষে আছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের ঐতিহাসিক আলোকচিত্র এবং তাদের সাহিত্যকর্মের অংশবিশেষতৃতীয় কক্ষে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলা একাডেমী সংশ্লিষ্ট দুর্লভ আলোকচিত্রআরো আছে জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, সুফিয়া কামাল, সুকান্ত ভট্টাচার্যের দুর্লভ আলোকচিত্র ও সাহিত্যকর্মের আংশিক চিত্র, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির অনুলিপিচার নম্বর কক্ষটিতে আছে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, শরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, লালন শাহ, হাসন রাজার দুর্লভ আলোকচিত্র ও কিছু নিদর্শন
একাডেমীর নতুন ভবন
সম্প্রতি যাত্রা শুরু করেছে বাংলা একাডেমীর নতুন ভবন৫০০ আসনবিশিষ্ট মিলনায়তনসহ এই ভবনে আছে সেমিনার কক্ষ, গ্রন্থাগার ও বাংলা একাডেমীর অন্যান্য গবেষণা কার্যক্রমের কার্যালয়



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

LinkWithin