হাতিরঝিল প্রকল্প নগর বিনোদনের নতুন প্রাণকেন্দ্র




মেহেদী হাসান


কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ বা প্রগতি সরণির বিরক্তিকর যানজট ঠেলে কোনোরকমে প্রবেশ করতে পারলেই অনাবিল সৌন্দর্য আর দৃষ্টিনন্দন লেক। এঁকেবেঁকে চলা রাস্তা, সড়কদ্বীপে রঙিন ফুল মন না মাতিয়ে পারে না। হঠাৎই চোখ আটকে যায় নৌকা বাইচে! তাও ইট-কাঠ আর কংক্রিটের এ নগরীতে। এ কী! রাজহাঁসের জলকেলিও তো চলছে! না! একে তো ঢাকা মনে হচ্ছে না! ঢাকার মধ্যে এ যেন এক স্বপ্নপুরী। এটি দেশের বিনোদনের সবচেয়ে বড় ও নান্দনিক স্থাপনা। বলছিলাম, সদ্য উন্মুক্ত হাতিরঝিল প্রকল্পের কথা।


যেভাবে শুরু

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সমীক্ষায় এ নতুন প্রকল্পের পরিকল্পনা হয় ২০০৭ সালের মাঝামাঝি। প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই শেষ হওয়ার পর ওই বছরেরই ৮ অক্টোবর একনেকের সভায় এটি অনুমোদন পায়। প্রাথমিক অবস্থায় এর ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৪৮০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ২০০৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এবং প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয় ২০০৯-এর জুন মাসে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার। কিন্তু ২০০৯-এর জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও জমি অধিগ্রহণ, বাড়িঘর উচ্ছেদ আর একাধিকবার নকশা বদলের কারণে এর বাস্তবায়নে ঘটেছে অনাকাক্সিক্ষত বিলম্ব। এ ছাড়াও আদালতে ঝুলে থাকা অনেক মামলাও নিষ্পত্তিতে সময় লেগেছে। তবে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল প্রকল্পের মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়িয়ে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত ধরা হলেও চলতি বছরের ২ জানুয়ারি বুধবার এটির উদ্বোধন করা হয়। শেষ পর্যন্ত এর ব্যয়ভার দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯৭১ কোটি টাকা।



এ এলাকায় যানজটের অন্যতম কারণ পূর্ব-পশ্চিমে সরাসরি কোনো সংযোগ সড়ক না থাকা। অর্থাৎ ধানমণ্ডি বা মোহাম্মদপুর থেকে কাউকে রামপুরা বা বাড্ডা যেতে হলে অনেক ঘুরতে হতো। তাই ১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৫৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে পান্থপথ-রামপুরা সংযোগ সড়ক বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত ছিল, হাতিরঝিল খাল ভরাট করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। পরে চারদলীয় জোট সরকারও প্রকল্পটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এক পর্যায়ে ঢাকা ওয়াসার আপত্তির কারণে প্রকল্প পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তখন বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শে হাতিরঝিলের নিম্নাঞ্চলের উপর এলিভেটেড এক্সেপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা হয়। তারপর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাদ দেওয়া হয় পান্থপথ-রামপুরা এলিভেটেড রোড প্রকল্প। এর পরিবর্তে নেওয়া হয় ‘বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প; বর্তমানে যা হাতিরঝিল প্রকল্প নামে খ্যাত।

প্রকল্পের সার্বিক অবস্থা
লেকের পাশে নির্মিত ভিউইং ডেক, সবুজে আচ্ছাদিত রাস্তার মেডিয়ান, ওয়াকওয়ের (হাঁটাপথ) পাশে গার্ডেনিং, ফুলে ফুলে শোভিত রাস্তার আইল্যান্ড, লেকের ধারে সবুজের সমারোহ আর স্বচ্ছ পানির রাস্তা ধরে এগিয়ে যাওয়া। অনেকটা কল্পনার মতো। আর এ ধরনের কল্পনা যানজটে পিষ্ট ঢাকায় বসে চিন্তার অতীত। না, উপরের এ বর্ণনা আর কল্পনা নয়। এটি এখন বাস্তব।

নতুন বছরের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ২ জানুয়ারি বহুল প্রতীক্ষিত হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকা জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করার মাধ্যমে নগরবাসীর জন্য খুলে দেওয়া হয় বিনোদনের নতুন এক প্রাণকেন্দ্র।

রাজধানী ঢাকার যান্ত্রিক জীবনে একটু নির্মল নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। এখন ছুটির দিনে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়ানোর কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে হাতিরঝিল সংলগ্ন প্রকল্প এলাকা।

খোলা আকাশের নিচে নির্মল বিনোদনের জায়গাই শুধু নয়, হাতিরঝিল প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকার দুঃসহ যানজট থেকে মুক্তি পাবে নগরবাসী। আর তাই তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি উদ্বোধনের পরপরই রাজহাঁস ছেড়ে দেওয়া হয় ঝিলের পানিতে, চলে নৌকাবাইচও।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে রাজধানীর হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা যে অন্যতম লক্ষ্য তা প্রধানমন্ত্রীকে ঝিল এলাকায় ঐতিহ্যবাহী সুসজ্জিত হাতি ও বাংলাঢোল দিয়ে স্বাগত জানানোই তার উদাহরণ। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, ‘এ প্রকল্পটি করার ফলে উৎসব অনুষ্ঠানের আরেকটি নতুন জায়গা তৈরি হলো।’

হাতিরঝিলের এ এলাকায় নগরবাসী যাতে নির্বিঘেœ পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে পারেন সেজন্য দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ বক্স স্থাপন করা হয়েছে। হাতিরঝিলের স্বচ্ছ জলাশয় দেখার জন্য রয়েছে ভিউইং ডেক। সবুজে আচ্ছাদিত রাস্তা ধরে গাড়ি নিয়ে ছুটে চলার পাশাপাশি রয়েছে ওয়াকওয়ে গার্ডেনিং। রাস্তার উপরে নির্মিত ফুটওভার ব্রিজ ধরে যে কেউ উপভোগ করতে পারবেন দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল জলাশয়। গুলশান-মেরুল বাড্ডা লিংক রোড ব্রিজ নির্মাণ শেষ হলে ঢাকা শহরে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচলে যুগান্তকারী ঘটনার সূচনা ঘটবে।

প্রকল্প এলাকায় আরো নির্মিত হচ্ছে অ্যাস্ফিথিয়েটার, লেকের পাশের চমৎকার সব স্থাপত্যকর্ম, ওয়াটার কোর্ট, ওয়াটার ট্যাক্সি টার্মিনাল। এসব তৈরি হলে এটি রাজধানীর সেরা বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হবে। প্রকল্পের পার্শ্ববর্তী এলাকার জনসাধারণের পানির চাহিদা পূরণ করতে চারটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।

এক হাজার ৯৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন-পশ্চিমের (এসডব্লিউও-পশ্চিম) ১৬ ইঞ্জিনিয়ার্স কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন (১৬ ইসিবি)।

প্রকল্পের নানা দিক
সোনারগাঁও হোটেল থেকে টঙ্গী ডাইভারশন রোড পর্যন্ত জলাশয়কে বলা হয় বেগুনবাড়ী খাল এবং টঙ্গী ডাইভারশন রোড থেকে রামপুরা ব্রিজের মধ্যবর্তী অংশের জলাশয়কে বলা হয় হাতিরঝিল। এ প্রকল্পের আওতায় বেগুনবাড়ী খাল সংস্কার, খালের উত্তর পাশে ওয়াকওয়ে এবং দক্ষিণ পাশে টুওয়ে সার্ভিস রোড নির্মাণ করা হয়েছে।

অন্যদিকে টঙ্গী ডাইভারশন রোড থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত একটি অত্যন্ত আধুনিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে, সেখানে শুধু একদিকে চলাচলের জন্য এক্সপ্রেসওয়ে এবং পাশাপাশি টুওয়ে সার্ভিস রোড নির্মাণ করা হয়েছে। এ রাস্তা নির্মাণের ফলে মগবাজার, মধুবাগ, উলন, মহানগর, দাসপাড়া, রামপুরা, মেরুল বাড্ডা, গুলশান, তেজগাঁও এবং বেগুনবাড়ী এলাকার লোকজনের যাতায়াত সহজ হবে। বর্তমানে প্রকল্পে মোট ৬টি ব্রিজ, ৪টি ওভারপাসের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ৪টি ব্রিজ লেকের উত্তর ও দক্ষিণ পাশের রাস্তাকে সংযুক্ত করেছে। হাতিরঝিল লেককে বনানী লেকের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য আরো একটি ব্রিজ এবং হাতিরঝিলের সঙ্গে গুলশান লেকের সংযোগ স্থাপন করতে একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। ওভারপাসগুলো এক্সপ্রেসওয়েতে সব ধরনের যানবাহনকে হাতিরঝিল এলাকায় কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই চলতে সহায়তা করবে।

বর্তমানে গুলশান-মেরুল বাড্ডা লিংক রোডে একটি ব্রিজ ও প্রগতি সরণিতে দুটি ইউলুপের নির্মাণ কাজ চলছে, যা পরবর্তীতে নতুনভাবে সংযোজন করা হচ্ছে। গুলশান-মেরুল বাড্ডা লিংক রোড ব্রিজ নির্মাণ শেষ হলে ঢাকা শহরে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচলে যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হবে। প্রগতি সরণিতে ইউলুপ দুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে প্রগতি সরণি যানজটমুক্ত হবে। বর্তমানে ইউলুপ নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে, যা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে।

পূর্ব-পশ্চিমে সংযোগ সড়কের লক্ষ্যে ৮.৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেস রোড নির্মাণ, স্থানীয় জনগণের যোগাযোগ সহজীকরণের জন্য ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সার্ভিস রোড, ৪৭৭.২৫ মিটার দীর্ঘ ৪টি ব্রিজ নির্মাণ, পথচারী ও ভ্রমণকারীদের সুবিধার্থে যথাক্রমে ৮.৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফুটপাথ এবং ৯.৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ লেক সাইড ওয়াকওয়ে নির্মাণ, ২৬০ মিটার দীর্ঘ তিনটি ভায়াক্ট নির্মাণ এবং প্রকল্প এলাকা যানজটমুক্ত রাখতে ৪০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ওভারপাস, ইন্টারসেকশন এবং রাউন্ড অ্যাবাউট নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রকল্পে ১০.৪৫ কোটি ঘনফুট বর্জ্য অপসারণ, ১০.৪০ কিমি মেইন ডাইভারশন স্যুয়ারেজ লাইন স্থাপন করে প্রকল্প এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে কার্যকর করে হাতিরঝিলের পরিবেশের বৈপ্লবিক উন্নতি সাধন করা হয়েছে ।

প্রকল্পটি গড়ে উঠেছে ৩০২ একর জমির উপর। এতে মোট খরচ হয়েছে এক হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণে এক হাজার ৪৮ কোটি ও বাকি টাকা নির্মাণকাজে ব্যয় হয়।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য
বৃষ্টির পানি ও পয়োনিষ্কাশনের মাধ্যমে রাজধানীর একটি বড় অংশের জলাবদ্ধতা দূর করা, বৃষ্টি ও বন্যাজনিত পানি ধারণ, নগরের নান্দনিক সৌন্দর্য বাড়ানো, রাজধানীর পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সার্বিক পরিবেশের উন্নয়ন করাই এ প্রকল্পের লক্ষ্য। হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ী খালের সঙ্গে বনানী ও গুলশান লেকের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটিকে ঘিরে একটি আধুনিক পয়োনিষ্কাশন নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে।

যানবাহন চলাচলের জন্য প্রকল্পে চারটি সেতু, চারটি উড়াল সড়ক, প্রায় ১৭ কিলোমিটার সড়ক, ২৬০ মিটার ভায়াডাক্ট (সেতুপথ) এবং প্রায় ১২ কিলোমিটার হাঁটার পথ নির্মাণ করা হয়েছে। গাড়িতে এ এলাকায় প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য এফডিসির পাশের মোড়ে, মগবাজার রেলক্রসিং ও রামপুরা সেতুর কাছে তিনটি পথ রয়েছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটি চালু হওয়ার ফলে ঢাকার যানজট কমবে।

দর্শনার্থীরা যা বলেন
‘ফুলপরী কখন নামবে?’ জানতে চায় ইনান। ২ জানুয়ারি তার জন্মদিন। এ বিশেষ দিনটিতে সে মা-বাবার সঙ্গে স্বপ্নপুরীতে এসেছে, কিন্তু পরী এখনো নামছে না কেন? ‘স্বপ্নপুরীতে পরী তো থাকতেই হবে, মাস্ট’Ñ অস্থির ইনান। এই স্বপ্নপুরী খুব দূরে নয়, ঢাকার ভেতরে, সদ্য উন্মুক্ত হাতিরঝিল প্রকল্প।
দিনে যার উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মধ্যরাতের আঁধার ভেদ করে সগর্বে উজ্জ্বল সেটি। রাত দুটো বাজলেও ইনানের মতো অনেকেই এসেছেন নগরের ইট-পাথর দেখে পচে যাওয়া চোখ দুটিকে একটু শান্তি দেওয়ার আশায়। ঢাকার ভেতরে এ যেন অন্য এক ঢাকা। পুরো এলাকার আভিজাত্য যেন হঠাৎ অনেক বেড়ে গেছে। মধ্যরাত পাত্তা না দিয়ে সেখানে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দর্শনার্থীরা। পানির কাছাকাছি বলেই হয়তো স্বপ্নপুরীতে শীতটাও অনেক কম।

নাখালপাড়া থেকে সপরিবারে বেড়াতে এসেছেন অবন্তি মৌসুমি। শিশুদের মা যেন নিজেই শিশু হয়ে গেলেন মধ্যরাতের হাতিরঝিল দেখে, ‘সর্বনাশ! কত রঙের আলো!’ একটু জিরিয়ে হঠাৎ মনে পড়েছেÑ এমনভাবে বললেন, ‘আমার তো মনে হচ্ছে সিডনি পৌঁছে গেছি!’ সঙ্গে সঙ্গে স্বামী তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমারও তেমন লাগছে। ঢাকার এ রূপ আগে দেখিনি।’

নিজের জন্মভূমি ঢাকা প্রসঙ্গে অবন্তির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, ‘আরে না এ তো দিনে ঢাকাটা ‘রাজধানী ঢাকা’র মতো দেখাচ্ছে।’ অবশ্য আক্ষেপ আছে তারিকুলের, ‘এমন সৌন্দর্য ধরে রাখলেই হয়। ক’দিন পর এ পানিতেই চিপসের প্যাকেট, ওয়ানটাইম ইউজড কন্টেনার, জুসের বোতল ভেসে বেড়াবে। পানি হবে কুচকুচে কালো। এই পানিই একসময় সবচেয়ে দৃষ্টিকটু হয়ে পড়বে। হাতিরঝিল আর চারপাশের ঢাকার মধ্যে ক’দিন পরই হয়তো আর কোনো পার্থক্যই থাকবে না।’

শুধু ইনান নয়, হেঁটে বা দৌড়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে আরো ক’টি শিশু। একজনের হাতে বল, তাতে আবার আলো জ্বলে, চিৎকার করছে শিশুটি, ‘হায়, হায়, আমার হাতে আগুন!’ বলেই আবার পিঠ বাঁকা করে খুব হাসি তার। শিশু মালিহা অবশ্য সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছে ব্রিজের রঙ বদলানোর বিষয়টি। অবাক হয়ে ধারাবিবরণী দিতে থাকে, ‘এই হলো বেগুনি, এবার হলো একটু লাল, এবার নীল।’ সাঁই সাঁই করে একের পর এক গাড়ি চলে যাচ্ছে। পুলিশের গাড়িও গেল অল্প কিছুক্ষণের ব্যবধানে দুটি। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরাও কড়া দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন সবার দিকে। একটু পর পরই স্বপ্নপুরীর সৌন্দর্যে বিমোহিত আর স্থির দর্শনার্থীরা। পানিতে বেদি বানিয়ে ফুলের টব রাখা কতটা রুচিশীল হয়েছে, তা নিয়েই আলোচনা করতে থাকলেন নিজেদের মধ্যে। ক’টি মোটরসাইকেল চলে গেল পাশ দিয়ে, প্রত্যেকটিতে তিনজন করে আরোহী। আনন্দোল্লাস করছেন ক’জন যুবক।

সব দেখে কিছুটা চিন্তিত চল্লিশোর্ধ্ব মগবাজারের বাসিন্দা আব্বাস সরকার। তার আশঙ্কা, ‘বড়লোকের উচ্ছৃঙ্খল ছেলেরা এটা ওটা খেয়ে পাগলের মতো বাইক চালাবে, আর পড়ে পড়ে মরবে এখানে।’ সমাধানও দেন তিনি, ‘এখানে একটা গতিসীমা ঠিক করে দেওয়া উচিত। কড়া করে সেটা মানতে বাধ্য করলে উল্টাপাল্টা করতে পারবে না কেউ।’ এদিক সেদিক নানামুখী রাস্তা দেখে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার সাহেব অস্থির হয়ে গেলেন, ‘আরে ধুর, পথ দেখি শেষ হয় না। কোন্দিক থেকে কোন্দিক যাই।’ একসময় অবশ্য বের হতে পারলেন তিনি। এতক্ষণ বিরক্ত থাকলেও এবার বলেন, ‘জিনিসটা বানাইসে ভালোই। বিদেশ বিদেশ লাগে।’

নোংরা হতে চলেছে প্রকল্প এলাকা
রাতে হাতিরঝিল দেখে বিদেশের কোনো স্থাপনা মনে হয়। তবে দিনে এমনটি ভাবার উপায় নেই। উদ্বোধনের কিছু দিন না যেতেই নোংরা হতে শুরু করেছে প্রকল্প এলাকা। স্থাপনার এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পরিত্যক্ত কাগজ, চিপস-সিগারেটের প্যাকেট, বাদামের খোসা, পলিথিনসহ আরো অনেক বর্জ্য।

আবর্জনা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট বাক্স থাকলেও দর্শনার্থীরা তা ব্যবহার করছেন না। এ বিষয়ে কয়েক নিরাপত্তাকর্মীর সাথে কথা বললে তারা জানান, অনেক বলার পরও অধিকাংশ দর্শনার্থীই নির্ধারিত বাক্সের বাইরে এটা সেটা ফেলে প্রকল্পের সৌন্দর্য নষ্ট করছেন। তবে দর্শনার্থীরা দাবি করেন, আবর্জনা ফেলার পর্যাপ্ত বাক্স নেই। এ ব্যাপারে দায়িত্বরত কর্মীরা জানান, বাক্সের সংখ্যা আরো বাড়ানো হচ্ছে।

প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দর্শনার্থীদের অনেকেই সিগারেট খাচ্ছেন। সিগারেটের গোড়া যত্রতত্র ফেলছেন। সিগারেটের প্যাকেট ফেলতে দেখা গেছে লেকের পানিতে। একজনকে দেখা গেল এক কোনায় দাঁড়িয়ে মূত্রত্যাগ করতে। প্রকল্পের বাগান থেকে ফুল ছেঁড়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। প্রকল্প দেখতে এসে সাথে থাকা বাচ্চাদের ফুল ছিঁড়ে দিচ্ছেন অনেকেই। বিভিন্ন জায়গায় এসব ফুলের ছেঁড়া অংশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

এমন দৃশ্য দেখে হাতিরঝিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসা কলেজ শিক্ষক রফিকুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের জন্য আসলে এসব না। এত সুন্দর একটা জায়গা আমরা কীভাবে নষ্ট করে ফেলছি। সবকিছু সরকারের উপর ছেড়ে না দিয়ে আমরাও যদি কিছুটা দায়িত্বশীল হতাম তবে খুব ভালো হতো।

হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রায়হানুল ফেরদৌস এ ব্যাপারে বলেন, নাগরিক সচেতনতার এতটা অভাব হলে খুবই সমস্যা। কর্তৃপক্ষকে তার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নাগরিকদেরও সচেতন হওয়া দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চাঁদের কলঙ্ক বিজিএমইএ ভবন
নান্দনিক ও দৃষ্টিনন্দন এ প্রকল্পের বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল খালের মাঝেই দাঁড়িয়ে বিজিএমইএ ভবন; যা সুন্দর চাঁদের মাঝে কলঙ্কের মতন। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নামমাত্র মূল্যে জমি নিয়ে ১৫তলা ভবনটি নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউকের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। জলাশয় ভরাট ও জল প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করায় এই ভবন নির্মাণ জলাধার সংরক্ষণ আইনের পুরোপুরি লঙ্ঘন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই অবৈধ ঘোষণা করা হয় এই ভবনটিকে।

এমনকি প্রস্তাবিত রাজধানীর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) বিবেচনায়ও ভবনটি পুরোপুরি অবৈধ। কারণ নির্মিত এই ভবন হয়েছে নিচু জমি ভরাট করে৷ নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন ভবনটি ভেঙে ফেলাই যুক্তিযুক্ত।

বিজিএমইএ ভবন ভাঙার বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গিয়েছে। হাইকোর্টের এক রায়ে ভবনটি ভেঙে ফেলারও সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ রাজউক বিজিএমইএ ভবনের সামনের টিনশেড স্থাপনা ভঙে দেয়। এরপর বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ আবার আপিল করে। আদালত ভবনটি ভাঙার উপর ছয় সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা জারি করে৷ কিন্তু ছয় সপ্তাহ পার হলেও এই মামলার নেই কোনো অগ্রগতি।

রাজধানীর বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল প্রকল্পে জলপ্রবাহে বড় বাধা তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ভবন। আদালতের দৃষ্টি অবৈধ আর পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো প্রকল্পের ভেতর এই ভবনকে আখ্যা দিয়েছে ‘মন্যুমেন্ট অব করাপশন’।

যদিও বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ী খালের পানি দূষণমুক্ত করা এবং রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করা। সঙ্গে রয়েছে রামপুরা, গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকার যানজট নিরসন।

এই প্রকল্পের পরামর্শক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক ড. মজিবুর রহমান বলেন, বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল প্রকল্পে বিজিএমইএ ভবন নিয়ে সবার মতো আমিও অন্ধকারে আছি। বিজিএমইএ জলাশয়ের পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। তাই এই ভবন এখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ আগেও ছিল, এখনও আছে। এই ভবন আইনসিদ্ধভাবে হয়নি বিধায় আদালতও সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, সরকার কীভাবে এটা বাস্তবায়ন করবে এখন তা দেখার বিষয়।

সরকারের আদালতের রায় না মানা প্রসঙ্গে নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান শরিফ বলেন, অবৈধ ভবন ভাঙার ক্ষেত্রে সরকারের আদালতের রায় মেনে তা বাস্তবায়ন করা উচিত। কিন্তু সরকারের শুধুমাত্র তাদের পক্ষে আদালত রায় দিলে সেই রায় বাস্তবায়নের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, আদালত জনস্বার্থে ভবনটি সরিয়ে নেওয়ার জন্য রায় দিলেও সরকার জনস্বার্থ বিবেচনা করছে না। প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্পের ভেতরে এই অবৈধ ভবন রেখে উদ্বোধন করার মাধ্যমেই অবৈধ ভবনের সমর্থন প্রকাশ পাচ্ছে।




বিশেষজ্ঞ অভিমত

চমৎকার এ প্রকল্পটি সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. সারওয়ার জাহান বলেন, চলতি বছরের ২ জানুয়ারিতে চালুকৃত রাজধানীর বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ঢাকা মহানগরীর পরিবেশসহ অন্যান্য সেবাখাতের মতন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে নগরবাসীর জন্য খুবই প্রয়োজন। যেমন এর ফলে রাজধানীর জলাবদ্ধতা অনেকটা দূরীকরণ, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং মধ্যবর্তী এলাকাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটা সহজতর হয়েছে। অন্যদিকে বায়ুদূষণ কমাতেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তবে সবচেয়ে যে বিষয়টি বড় পাওয়া তা হলো এটি বাস্তবায়নের ফলে নগরবাসীর বিনোদনের জন্য একটি চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

প্রকল্পটির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকল্পটির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সঠিক তদারকির অভাবে এর পরিবেশ যেন বিনষ্ট না হয়, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। এজন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রয়োজনে এটি দেখভাল করার জন্য ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করে স্থানীয় প্রশাসনের হাতে ছেড়ে দিতে পারলে ভালো হয়।

পরিশেষ
গত বছর বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসের অযোগ্য শহর নির্বাচিত হয়েছে মেগাসিটি ঢাকা, যা আমাদের জন্য সত্যিই খুব লজ্জার। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের ‘বৈশ্বিক বসবাস উপযোগিতা’ শীর্ষক এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০১২ সালে বিশ্বের ১৪০টি শহরকে এ জরিপের আওতায় আনা হয়। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসুবিধা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামোর মানদ-ের ভিত্তিতে এ সূচক তৈরি করা হয়েছে। ঢাকা নগরীকে ‘নিকৃষ্ট নগরীর’ লজ্জা থেকে বাঁচাতে এ ধরনের সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প আরো বেশি করে গ্রহণ করা প্রয়োজন।

একনজরে
প্রকল্পের নাম : হাতিরঝিল প্রকল্প
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা : বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
প্রকল্প তত্ত্বাবধানকারী : রাজউক, এলজিইডি, ওয়াসা এবং বুয়েট
প্রকল্প জরিপ ও নকশা প্রণয়নকারী সংস্থা : বুয়েট
মোট জমির পরিমাণ : ৩০২ দশমিক ৮৭ একর
মোট বাজেট : এক হাজার ৯৭১ কোটি টাকা
প্রকল্প শুরু : ২০০৭ সালের ৮ অক্টোবর
প্রকল্পের উদ্বোধন : ২ জানুয়ারি ২০১৩





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

LinkWithin