গ্রীন বিল্ডিং কনসেপ্ট ও আমরা

আজকাল বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পরিবেশবান্ধব স্থাপনার ক্ষেত্রে  যে বিষয়গুলোর উপর অধিক গুরুত্বারোপ করছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গ্রীন বিল্ডিং কনসেপ্ট (এৎববহ ইঁরষফরহম ঈড়হপবঢ়ঃ). মাটি, বাঁশ, কাঠ ইত্যাদি দেশীয় সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে তৈরি করছে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা, যেগুলোকে বলা হচ্ছে গ্রীন বিল্ডিং অথবা ইকো ফ্রেন্ডলি বিল্ডিং (ঊপড় ঋৎরবহফষু ইঁরষফরহম). বাংলাদেশের অনেক স্থপতি দেশীয় উপকরণের ব্যবহার শুরু করেছে যা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। গ্রীন বিল্ডিং কনসেপ্ট আসলে অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে; যেমনÑ প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, অর্থনৈতিক ভারসাম্য, সামাজিক শৃঙ্খলা-স্থাপন, তৈরির উপকরণ থেকে শুরু করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও গ্রীন বিল্ডিং কনসেপ্টের মধ্যে পড়ে।

এখন প্রশ্ন হলো এই সবুজ আবাসনের ধারণা কিংবা চিন্তা কি আমাদের জন্য একেবারেই নতুন কিছু? অন্যভাবে বলা যায়, আমরা কি এর সাথে অনেক আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম না। এরই কিছু বাস্তবচিত্র তুলে ধরা হলো।

প্রথমেই আসা যাক, স্থাপনা তৈরির উপকরণ হিসেবে মাটির ব্যবহার। আমরা যদি একটু ভালোভাবে লক্ষ করি তাহলে দেখা যাবে আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে এখনও অনেক চৌচালা কিংবা দোচালা বাড়ি রয়েছে যেগুলোর পার্শ্ব দেয়াল ১০-১৫ ইঞ্চি মাটির তৈরি। এগুলোর গঠনশৈলী পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে দেয়ালগুলোর ভেতরে বাঁশের তৈরি ফ্রেম বিদ্যমান যা নির্মাণ উপকরণ হিসেবে কাজ করছে। অনেক ক্ষেত্রে কাদা মাটির সাথে খড় মিলিয়ে ম- তৈরি করে তারপর সেটাকে নির্দিষ্ট আকার এনে দেয়াল তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ভেতরের স্তরে চট বা পাটের দড়ি (পাটের আঁশ) ব্যবহারও এ দেশে অত্যন্ত প্রাচীন। গৃহস্থরা প্রতিদিন দেয়ালে পানি, মাটি ও অন্যান্য জৈব পদার্থ মিলিয়ে আস্তরণ দিয়ে থাকে যার দরুন সেটি হয় অনেক শক্ত ও মজবুত, যা সহজে ক্ষয় হয় না।

অধিকাংশ গ্রামে চৌচালা কিংবা দোচালা টিনের ছাদ দেওয়া হয়। যেখানে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ার জন্য খাঁজ কাটা হয় এবং সহজে বৃষ্টির পানি মাটিতে স্থাপনার একপাশ দিয়ে মাটিতে পড়ে এবং অনেক বাড়িতে এই পানি সংরক্ষণের জন্য পাশে একটি চিকন ড্রেন তৈরি করে সংরক্ষণ করে বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়। এটাকে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং (জধরহ ডধঃবৎ ঐধৎাবংঃরহম) পদ্ধতির সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ছাদে ঢেউটিন (গবঃধষ ঞরহ) ব্যবহার করে নিচে চাটাই বা বাঁশের তৈরি এক ধরনের পাতলা পার্টিশন ব্যবহার করা হয়। যার দরুন টিন এবং পাশের পার্টিশনের মাঝে এয়ার গ্যাপ (অরৎ এধঢ়) তৈরি হয়, যা ঘরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোর্টইয়ার্ড কনসেপ্ট (ঈড়ঁৎঃুধৎফ ঈড়হপবঢ়ঃ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যা বর্তমানে গ্রীন বিল্ডিংয়ের অপরিহার্য অংশ যেখানে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলোতেও আলো বাতাস চলাচলের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। আমাদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী সাধারণত প্রতিটা বিল্ডিংয়ের জন্য তার মধ্যবর্তী স্থানে (১স ী ১স) জায়গা নিম্নপক্ষে ছেড়ে দেওয়ার বিধান রয়েছে। যার দরুন স্থাপনা যদি ৩তলা বিশিষ্ট হয় তাহলে কোর্টইয়ার্ডের সর্বনিম্নœ পরিমাণ হবে ৩স ী ৩স আবার স্থাপনা যদি ৪তলা বিশিষ্ট হয় যার কোর্টইয়ার্ড হবে ৪স ী ৪স।

এবার আমরা যদি একটু ভালোভাবে লক্ষ করি তাহলে দেখা যাবে আমাদের দেশে পুরনো স্থাপনা, গ্রামের বসতবাড়ির কোর্টইয়ার্ড কিংবা বসতবাড়ির অভ্যন্তরে বর্গাকৃতি অথবা আয়তাকার ফাঁকা জায়গা বিদ্যমান থাকে, অনেক ক্ষেত্রে এটাকে উঠান বলা হয়। এই উঠান একটু বড় হলে সেখানে অনেক ধরনের গাছ লাগানো হয়। এমনকি সবজি বাগানও করা যেতে পারে। এই উঠান বা কোর্টইয়ার্ড সাধারণত বারান্দা দ্বারা চারপাশ থেকে আবদ্ধ থাকে। আর বারান্দার সাথে সংযুক্ত থাকে বিভিন্ন ধরনের ঘর বা স্পেস।
অথচ বর্তমানে আমরা নতুন যে অ্যাপার্টমেন্ট ভবন কিংবা আবাসন তৈরি করছি যার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই কনসেপ্ট দেখা যায় না। এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয়Ñ
ক্স    জমির অতি উচ্চ মূল্য
ক্স    ফাঁকা জমির পরিমাণ কমে যাওয়া
ক্স    অপরিকল্পিত নগরায়ণ ইত্যাদি।

গ্রামগঞ্জে বাড়ির চারপাশে বিভিন্ন ধরনের ঋতুভিত্তিক গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করা হয় অতি প্রাচীন কাল থেকেই। যদি পাশে কোনো জলাশয় বিদ্যমান থাকে তাহলে ঐ জলাশয়ের পানি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এসব ক্ষেত্রে এমনকি এই গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক চাহিদার পূরণও সম্ভব।
যা ১৯৮০ সাল থেকে ইউরোপে ল্যান্ডস্কেপ স্থাপত্যে বহুল পরিচিতি লাভ করে এবং গ্রীন বিল্ডিং কনসেপ্টে গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে পয়েন্ট নির্ধারণও করা হয়। অথচ আমরা আমাদের পুরনো স্থপনাগুলোতে কিংবা গ্রামের বাড়িগুলোতে সুযোগ পেলে শহরের স্থাপনাগুলোতেও সব সময় বাড়ির চারপাশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম ফলজ বৃক্ষ রোপণ করে থাকি। এমনকি ছাদেও সবজি বাগান করতে দেখা যায়। আমাদের মাটি অত্যন্ত উর্বর আর এই উর্বর মাটিতে অতি অল্প সময়ে গাছগুলো বেড়ে ওঠে আমাদের দেশের আলো বাতাসে। তাই একটু সদিচ্ছা থাকলে রুফ গার্ডেন (জড়ড়ভ এধৎফবহ) কিংবা ল্যান্ডস্কেপিং (খধহফংপধঢ়রহম) আমাদের জন্য কঠিন কিছু না। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে বাংলাদেশ জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালায় বলা আছে বাড়ির চারপাশে যে খোলা জায়গা বিদ্যমান তার ৫০% আচ্ছাদিত থাকবে এবং যেখানে কোনো রকমের চধাবসবহঃ ড়ভ ঝঁৎভধপরহম করা যাবে না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই খোলা জায়গাগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি চঁৎষরহম কিংবা আচ্ছাদন তৈরি করা হচ্ছে।

গ্রীন বিল্ডিংয়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো শেডিং ডিভাইস (ঝযধফরহম উবারপব)। বর্তমানে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ এ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ শেডিং ডিভাইসের মাধ্যমে একদিকে যেমন সূর্যের আলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, অন্যদিকে বিভিন্ন পরিবেশগত বিপর্যয় থেকে অভ্যন্তরকে রক্ষা করা যায়। বর্তমানে বাজারে অ্যালুমিনিয়াম থেকে শুরু করে কাঠের তৈরি বিভিন্ন ধরনের সোলার শেডিং ডিভাইস (ঝড়ষধৎ ংযধফরহম ফবারপব) পাওয়া যায়। অথচ আশ্চর্য হলেও সত্য যে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা অনেক পুরনো স্থাপনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরন এবং ধাঁচের শেডিং ডিভাইস বা ঝপৎববহ দেখতে পাওয়া যায়, যার গঠনশৈলী থেকে শুরু করে কার্যপ্রণালী সবসময় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে আসছিল অথচ আমরা সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের এই স্থাপতিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রায় ভুলতে বসেছি এবং সেই সাথে ভিনদেশীয় স্থাপত্য ভাবনাকে এই দেশের মাটিতে সমর্থন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যার দরুন আমরা আমাদের ঐতিহ্য-কৃষ্টি-কালচার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। যা আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ আমরা যদি আমাদের স্থাপনার ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রযুক্তি-ঐতিহ্য ব্যবহার করতে পারি সেটিই হবে আসল স্বকীয়তা।

সহযোগিতায় :
লিমা, নিশান, রাফি, তাসমিয়া, নিহা, মূর্ছনা, সিকাদ, স্থাপত্য বিভাগ, চুয়েট।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

LinkWithin